রবিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৩ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স শ্রেষ্ঠ, কিন্তু সেবার মান নিয়ে জনমনে প্রশ্ন

 

সিলেট বিভাগের শ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সম্প্রতি স্বীকৃতি পেলেও, বাস্তব চিত্রে রয়েছে নানা অসংগতি। হাসপাতালে সেবার মান ও অবকাঠামো নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে তীব্র অসন্তোষ। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েব পোর্টালে ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স দেশের ১৯তম এবং সিলেট বিভাগে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও, বর্তমানে এটি সারা দেশের ৪৯০টি উপজেলার মধ্যে ১১তম এবং বিভাগীয়ভাবে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। কিন্তু এই স্বীকৃতির সঙ্গে বাস্তব সেবার মানের কোনো মিল খুঁজে না পাওয়ায় অনেকেই একে “হাস্যকর স্বীকৃতি” বলছেন বলছেন স্থানীয়রা। এতে স্বাস্থ্যসেবা মূল্যায়নের মানদণ্ড ও স্বচ্ছতা নিয়েও জনগণের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সামান্য জ্বর বা কাশি নিয়ে আসা রোগীকেও উন্নত চিকিৎসার কথা বলে সিলেট শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এতে রোগী ও স্বজনদের ভোগান্তি চরমে পৌঁছায়। হাসপাতালের শৌচাগারগুলোর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক, যেখানে পর্যাপ্ত আলো পর্যন্ত নেই। এছাড়া চিকিৎসক সংকট, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রীর অভাব, রোগীদের দীর্ঘ সময় বসিয়ে রাখা, ভুল ওষুধ প্রদান এবং অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগও রয়েছে। এই অবস্থার মধ্যেও ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স শ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র হিসেবে নির্বাচিত হওয়ায় অনেকে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ। জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, এই হাসপাতাল যদি শ্রেষ্ঠ হয়, তবে বাকি হাসপাতালগুলোর অবস্থা কতটা ভয়াবহ? কেউ কেউ বলছেন, হয়তো অন্য হাসপাতালগুলো আরও খারাপ, তাই খারাপের মধ্যে সবচেয়ে কম খারাপ হিসেবেই ছাতক শ্রেষ্ঠ হয়েছে।
এদিকে, ফেসবুক থেকে ছাতক হাসপাতাল নিয়ে পাওয়া বিভিন্ন মন্তব্য বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, সাধারণ জনগণের মধ্যে এই হাসপাতালের সেবার মান নিয়ে গভীর অসন্তোষ, ক্ষোভ ও হতাশা রয়েছে। অনেকেই অভিযোগ করছেন যে, হাসপাতালে দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তারদের বয়স অল্প, অভিজ্ঞতা কম এবং চিকিৎসার জ্ঞানও সন্দেহজনক। একাধিক রোগীর অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, প্রেসক্রিপশন লেখার জন্য ৫০ টাকা ‘হাদিয়া’ দিতে হয়, অনেক সময় ডাক্তাররা ওষুধের নামের বানান ভুল করেন, রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থ হন এবং জটিল রোগ যেমন স্ট্রোক বা হার্ট ব্লকের লক্ষণ শনাক্ত করতে পারেন না। শুধু তাই নয়, রাত্রিকালীন সময়ে হাসপাতালের সেবা আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। রাতের বেলায় জরুরি রোগী নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা ঘুমিয়ে থাকেন, অনেক সময় চিকিৎসা না দিয়ে সকালে আসতে বলেন এবং ইসিজির মতো গুরুত্বপূর্ণ টেস্টও করাতে অনীহা প্রকাশ করেন। চিকিৎসা না করে কিংবা যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া শুধু পেইন কিলার দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেন ডাক্তাররা। হাসপাতালের নার্সদের আচরণ নিয়েও ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। তারা রোগীদের সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করেন এবং চিকিৎসার খুঁটিনাটি বিষয় যেমন ওষুধের নিয়ম, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বুঝিয়ে বলেন না। এমন অব্যবস্থাপনা ও অভিজ্ঞতার অভাব থাকার সত্ত্বেও এই হাসপাতালকে সিলেট বিভাগের ‘শ্রেষ্ঠ’ ঘোষণা করা নিয়েও অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এবং এটিকে ‘আজব দেশের গুজব’ বলেও ব্যঙ্গ করেছেন অনেকে। সেবার এমন মান নিয়েও কীভাবে ছাতক হাসপাতাল শ্রেষ্ঠত্বের খেতাব পেল, তা সাধারণ মানুষের কাছে এক ধরণের রহস্যে পরিণত হয়েছে। পুরো ব্যবস্থাটিই যেন দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অপেশাদারিত্ব এবং দায়িত্বহীনতার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে, যা শুধু হাসপাতাল নয়, সামগ্রিকভাবে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়েও বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নুসরাত আরেফিন বলেন, ছাতক প্রথম হওয়া ছাতকবাসীর জন্য গর্বের বিষয়। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি, যদিও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে যতটা সম্ভব, ততটাই সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। নেতিবাচক মন্তব্য শুনলে মন খারাপ হয়, তবুও সেবার মান উন্নয়নে আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. জসিম উদ্দিন বলেন, ছাতকে কী পরিমাণ রোগী হয়, কী পরিমাণ ডেলিভারি হয়? সে অনুযায়ী এই হাসপাতাল সেরা হয়েছে। ছাতক মেডিকেলের স্বাস্থ্যসেবা যথেষ্ট ভালো। এটা একটি উপজেলা হাসপাতাল, এখানে সব চিকিৎসা করা সম্ভব না। তাহলে জেলা বা বিভাগীয় হাসপাতাল কেন? তিনি আরও বলেন, জনবল সংকট সারা দেশেই রয়েছে। তারপরও ছাতক মেডিকেল ভালো করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখানে ডেলিভারি রোগীদের সিজারিয়ান অপারেশনও সিলেট বিভাগের অন্য যেকোনো উপজেলার চেয়ে বেশি হয়। ডাক্তার সংকটের মধ্যেও ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়া হচ্ছে। যেখানে ৮ ঘণ্টার ডিউটি করার কথা, সেখানে অনেক সময় ১৬ ঘণ্টা করে কাজ করছেন চিকিৎসকরা। তারপরও তাদের ধন্যবাদ না দিয়ে সমালোচনা করা ঠিক নয়। মানুষের চাহিদা বেশি, তবে আমরা তা পূরণের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Sylhet Vision

ফকির দুর্ব্বিন শাহ: রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত এক লোকসংগীত সাধক

ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স শ্রেষ্ঠ, কিন্তু সেবার মান নিয়ে জনমনে প্রশ্ন

প্রকাশের সময় : ০১:৫৫:৪৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

 

সিলেট বিভাগের শ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সম্প্রতি স্বীকৃতি পেলেও, বাস্তব চিত্রে রয়েছে নানা অসংগতি। হাসপাতালে সেবার মান ও অবকাঠামো নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে তীব্র অসন্তোষ। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েব পোর্টালে ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স দেশের ১৯তম এবং সিলেট বিভাগে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও, বর্তমানে এটি সারা দেশের ৪৯০টি উপজেলার মধ্যে ১১তম এবং বিভাগীয়ভাবে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। কিন্তু এই স্বীকৃতির সঙ্গে বাস্তব সেবার মানের কোনো মিল খুঁজে না পাওয়ায় অনেকেই একে “হাস্যকর স্বীকৃতি” বলছেন বলছেন স্থানীয়রা। এতে স্বাস্থ্যসেবা মূল্যায়নের মানদণ্ড ও স্বচ্ছতা নিয়েও জনগণের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সামান্য জ্বর বা কাশি নিয়ে আসা রোগীকেও উন্নত চিকিৎসার কথা বলে সিলেট শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এতে রোগী ও স্বজনদের ভোগান্তি চরমে পৌঁছায়। হাসপাতালের শৌচাগারগুলোর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক, যেখানে পর্যাপ্ত আলো পর্যন্ত নেই। এছাড়া চিকিৎসক সংকট, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রীর অভাব, রোগীদের দীর্ঘ সময় বসিয়ে রাখা, ভুল ওষুধ প্রদান এবং অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগও রয়েছে। এই অবস্থার মধ্যেও ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স শ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র হিসেবে নির্বাচিত হওয়ায় অনেকে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ। জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, এই হাসপাতাল যদি শ্রেষ্ঠ হয়, তবে বাকি হাসপাতালগুলোর অবস্থা কতটা ভয়াবহ? কেউ কেউ বলছেন, হয়তো অন্য হাসপাতালগুলো আরও খারাপ, তাই খারাপের মধ্যে সবচেয়ে কম খারাপ হিসেবেই ছাতক শ্রেষ্ঠ হয়েছে।
এদিকে, ফেসবুক থেকে ছাতক হাসপাতাল নিয়ে পাওয়া বিভিন্ন মন্তব্য বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, সাধারণ জনগণের মধ্যে এই হাসপাতালের সেবার মান নিয়ে গভীর অসন্তোষ, ক্ষোভ ও হতাশা রয়েছে। অনেকেই অভিযোগ করছেন যে, হাসপাতালে দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তারদের বয়স অল্প, অভিজ্ঞতা কম এবং চিকিৎসার জ্ঞানও সন্দেহজনক। একাধিক রোগীর অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, প্রেসক্রিপশন লেখার জন্য ৫০ টাকা ‘হাদিয়া’ দিতে হয়, অনেক সময় ডাক্তাররা ওষুধের নামের বানান ভুল করেন, রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থ হন এবং জটিল রোগ যেমন স্ট্রোক বা হার্ট ব্লকের লক্ষণ শনাক্ত করতে পারেন না। শুধু তাই নয়, রাত্রিকালীন সময়ে হাসপাতালের সেবা আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। রাতের বেলায় জরুরি রোগী নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা ঘুমিয়ে থাকেন, অনেক সময় চিকিৎসা না দিয়ে সকালে আসতে বলেন এবং ইসিজির মতো গুরুত্বপূর্ণ টেস্টও করাতে অনীহা প্রকাশ করেন। চিকিৎসা না করে কিংবা যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া শুধু পেইন কিলার দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেন ডাক্তাররা। হাসপাতালের নার্সদের আচরণ নিয়েও ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। তারা রোগীদের সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করেন এবং চিকিৎসার খুঁটিনাটি বিষয় যেমন ওষুধের নিয়ম, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বুঝিয়ে বলেন না। এমন অব্যবস্থাপনা ও অভিজ্ঞতার অভাব থাকার সত্ত্বেও এই হাসপাতালকে সিলেট বিভাগের ‘শ্রেষ্ঠ’ ঘোষণা করা নিয়েও অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এবং এটিকে ‘আজব দেশের গুজব’ বলেও ব্যঙ্গ করেছেন অনেকে। সেবার এমন মান নিয়েও কীভাবে ছাতক হাসপাতাল শ্রেষ্ঠত্বের খেতাব পেল, তা সাধারণ মানুষের কাছে এক ধরণের রহস্যে পরিণত হয়েছে। পুরো ব্যবস্থাটিই যেন দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অপেশাদারিত্ব এবং দায়িত্বহীনতার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে, যা শুধু হাসপাতাল নয়, সামগ্রিকভাবে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়েও বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নুসরাত আরেফিন বলেন, ছাতক প্রথম হওয়া ছাতকবাসীর জন্য গর্বের বিষয়। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি, যদিও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে যতটা সম্ভব, ততটাই সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। নেতিবাচক মন্তব্য শুনলে মন খারাপ হয়, তবুও সেবার মান উন্নয়নে আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. জসিম উদ্দিন বলেন, ছাতকে কী পরিমাণ রোগী হয়, কী পরিমাণ ডেলিভারি হয়? সে অনুযায়ী এই হাসপাতাল সেরা হয়েছে। ছাতক মেডিকেলের স্বাস্থ্যসেবা যথেষ্ট ভালো। এটা একটি উপজেলা হাসপাতাল, এখানে সব চিকিৎসা করা সম্ভব না। তাহলে জেলা বা বিভাগীয় হাসপাতাল কেন? তিনি আরও বলেন, জনবল সংকট সারা দেশেই রয়েছে। তারপরও ছাতক মেডিকেল ভালো করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখানে ডেলিভারি রোগীদের সিজারিয়ান অপারেশনও সিলেট বিভাগের অন্য যেকোনো উপজেলার চেয়ে বেশি হয়। ডাক্তার সংকটের মধ্যেও ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়া হচ্ছে। যেখানে ৮ ঘণ্টার ডিউটি করার কথা, সেখানে অনেক সময় ১৬ ঘণ্টা করে কাজ করছেন চিকিৎসকরা। তারপরও তাদের ধন্যবাদ না দিয়ে সমালোচনা করা ঠিক নয়। মানুষের চাহিদা বেশি, তবে আমরা তা পূরণের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।