বাংলার লোকসংগীতের অঙ্গনে এক উজ্জ্বল নাম ফকির দুর্ব্বিন শাহ। তিনি শুধু একজন বাউল নন, ছিলেন ভাটি বাংলার আত্মা, সুফি সাধক, দার্শনিক ও মানবতার বাণীবাহক। ১৯২১ সালের ২ নভেম্বর সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার নোয়ারাই গ্রামের তারামনি টিলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সুফি সাধক সফাত আলী শাহ এবং মাতা হাসিনা বানুর আধ্যাত্মিক পরিবেশেই তাঁর বেড়ে ওঠা। মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও সঙ্গীত, আধ্যাত্মিকতা ও দর্শনে দুর্ব্বিন শাহ ছিলেন অসামান্য। কৈশোরেই গ্রামের আখড়ায় গান গেয়ে পরিচিতি পান। তিনি ছিলেন “মালজোড়া গানের জনক” যে ধারার গান প্রেম, দেহতত্ত্ব, সুফি দর্শন, সমাজচেতনা ও মানবতাবাদের অপূর্ব সমন্বয়। প্রায় এক হাজারের বেশি গান রচনা করেন তিনি, যার মধ্যে চার শতাধিক গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। তার কালজয়ী গানগুলো হলো “নামাজ আমার হইলো না আদায়”, “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি”, “ছাড়িয়া যাইও না বন্ধু রে”, “আমার অন্তরায়, আমার কলিজায়” আজও গ্রাম বাংলার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালেও তাঁর সৃষ্ট জাগরণী গান যেমন “চল রে ভাটি দেশে, যাইয়া হাওরে” মুক্তিকামী মানুষের মাঝে চেতনার দীপ্তি ছড়ায়। অস্ত্র হাতে না নিয়েও সুরের শক্তিতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সংগ্রামী জনতার প্রেরণা। ১৯৬৭ সালে কিংবদন্তি শিল্পী শাহ আবদুল করিমের সঙ্গে লন্ডনে গান পরিবেশন করে পান “জ্ঞানের সাগর” উপাধি। ঋত্বিক ঘটকের বিখ্যাত চলচ্চিত্র “যুক্তি তক্কো আর গপ্পো”-তেও ব্যবহৃত হয় তাঁর গান। ১৯৭৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন এই মরমি সাধক। মৃত্যুর পাঁচ দশক পরেও ছাতকের “দুর্ব্বিন টিলা”-য় প্রতিবছর অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী গান গেয়ে তাঁকে স্মরণ করেন। তাঁর গান যেন আজও জীবন্ত লোকপ্রেমিক, সাধক ও গবেষকদের কণ্ঠে কণ্ঠে বহমান।
ফকির দুর্ব্বিন শাহ ছিলেন বাংলার আত্মার প্রতিচ্ছবি, যাঁর গান কেবল বিনোদন নয় ছিল আধ্যাত্মিকতা, নৈতিকতা ও মানবতাবাদের পাঠ। তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে, প্রেমসাগর পল্লীগীতি, পাক বঙ্গ ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ গীতি, আল্লামা দুর্ব্বিন শাহ, ফকির দুর্ব্বিন শাহ এবং দুর্ব্বিন শাহ সমগ্র। উল্লেখযোগ্য, তার অন্যতম ভক্ত সুমনকুমার দাশ “দুর্বিন শাহ সমগ্র” রচনা করে ২০২৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরুষ্কারে ভূষিত হন। তবু প্রশ্ন থেকে যায় যে, লালন, হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিম রাষ্ট্রীয় সম্মান পেলেও, বাংলার লোকসঙ্গীত ইতিহাসে এতবড় অবদান রেখেও ফকির দুর্ব্বিন শাহ কেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত?