শনিবার, ২৩ অগাস্ট ২০২৫, ৮ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সিলেট পাথর কান্ডে এখনও বহাল তবিয়তে বিভাগীয় কমিশনার

  • ভিশন ডেস্ক ::
  • প্রকাশের সময় : ০৪:৩১:৪৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২২ অগাস্ট ২০২৫

সিলেটের ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর লুটের ঘটনায় বিভাগীয় কমিশনারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তীব্র সমালোচনা করছেন পরিবেশবাদীরা। তারা বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবীকে পাথর লুটের ‘উসকানিদাতা’ হিসাবে অভিযুক্ত করছেন।

এদিকে বৃহস্পতিবার দায়িত্ব গ্রহণ করেই সাদাপাথর এলাকায় ছুটে যান সিলেটের নবাগত জেলা প্রশাসক মো. সারোয়ার আলম। যাওয়ার পথে তিনি হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে অভিযানে নামেন। বীভৎস, বিবর্ণ সাদা পাথরের দৃশ্য দেখে তিনি বলেন, কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথরকে আগের রূপে ফিরিয়ে আনতে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অন্যদিকে গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন বন্ধে অভিযান চালিয়েছে টাস্কফোর্স। এ সময় অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত থাকায় ৩ জনকে আটক করে ১ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নেতৃত্বাধীন টাস্কফোর্স। ‘লুট ঠেকাতে ব্যর্থ’ কোম্পানীগঞ্জের ইউএনওর ‘প্রাইজ পোস্টিং’ নিয়েও সমালোচনামুখর পরিবেশবাদীরা।

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, সাদা পাথর লুটের ঘটনায় উসকানিদাতা হিসাবে যার নাম সবার আগে আসে তিনি বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী। পাথর উত্তোলনের দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলন থামাতে পাথর উত্তোলনের পক্ষে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে হাততালি পেয়েছিলেন তিনি।

তার সেই বক্তব্যই পাথর লুটকারীদের সাহস জুগিয়েছে এবং স্থানীয় প্রশাসনকে শিথিল করেছে। একই অভিযোগ করা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনেও। সাদা পাথরকাণ্ডে জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। লুটকাণ্ড ঠেকাতে কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও আজিজুন্নাহার পুরোপুরি ব্যর্থ। এমনকি দুদকের প্রতিবেদনে তার যোগসাজশের কথা বলা হলেও তাকে প্রত্যাহার না করে ভালো স্থানে পোস্টিং নিয়েও নানা সমালোচনা চলছে সিলেটজুড়ে। যদিও ঘটনার প্রায় ১০ দিন পর বুধবার কোম্পানীগঞ্জ সাদা পাথর পরিদর্শনে গিয়ে এসব প্রশ্নের জবাবে কমিশনার বলেছেন, তার বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

তার বক্তব্য ছিল ইজারার মাধ্যমে বৈধভাবে পাথর উত্তোলনের বিষয়ে। অন্য কিছু নয়। তিনি অস্বীকার করলেও ৮ জুলাই নিজ কার্যালয়ে দেওয়া বিভাগীয় কমিশনারের সেই জ্বালাময়ী বক্তব্যের রেকর্ড যুগান্তরের কাছে রয়েছে।

পাথর উত্তোলনসহ ছয় দফা দাবিতে আন্দোলনরত পরিবহণ মালিক-শ্রমিক নেতারা ৮ জুলাই সকাল ৬টা থেকে সিলেট জেলাজুড়ে পণ্য ও গণপরিবহণে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করেন। দুপুরে প্রশাসনের দাবি পূরণের আশ্বাসে কর্মবিরতি স্থগিত করে বিকালে বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে আলোচনায় বসেন আন্দোলনকারীরা। সঙ্গে ছিলেন সিলেটের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা।

ওই সভায় সিলেটের বিভাগী কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী বলছেন, সিলেট কোনো বিচ্ছিন্ন এলাকা নয়, দেশের একটা অংশ। সারা দেশে পাথর উত্তোলন করা গেলে সিলেটে যাবে না কেন? এর সঙ্গে মানুষের জীবন ও জীবিকা জড়িত। তিনি বলেন, আমি মনে করি মানুষ পরিবেশ ও প্রকৃতির বাইরে নয়। মানুষ না বাঁচলে সারা প্রকৃতি-পরিবেশ বাঁচলে কী লাভ। সব সময়ই বলি, আকাশ আছে, বালি আছে, পাথর আছে, মানুষ নাই-তাহলে আপনি কী করবেন?

স্থানীয়দের মতে, জুলাই মাসের শুরুর দিকে এমন বক্তব্যের পরই প্রশাসনের শিথিলতা চোখে পড়ে। সেই সুযোগেই সম্প্রতি সাদাপাথর ও জাফলংয়ে ভয়াবহ লুট হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি-বেলার সিলেটের সমন্বয়কারী শাহ শাহেদা আক্তার যুগান্তরকে বলেন, একজন বিভাগীয় কমিশনার যখন এমন বক্তব্য দেন, তখন আর কারও মনে ভয় থাকার কথা নয় এবং সেটাই হয়েছে। নির্ভয়ে লুটে নিয়েছে লুটপাটকারীরা।

তিনি মনে করেন, বিভাগীয় কমিশনারের এমন বক্তব্য স্থানীয় প্রশাসনকে ছাড় দিতে সহায়তা করেছে। তিনি আরও বলেন, বিভাগীয় কমিশনার সরকারের প্রতিনিধি। পরিবেশ-প্রকৃতি বাঁচানো যার দায়িত্ব তিনি পরিবেশকে খাটো করে বক্তব্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন তিনি সরকার নয়, পাথর ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি হিসাবে কথা বলেছেন। এমনকি তিনি যেসব কথা বলেছেন তা আদালত অবমাননাকর। আদালতের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে যেখানে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকার যেহেতু বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে জেলা প্রশাসককে প্রত্যাহার করেছে, তেমনি সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে বিভাগীয় কমিশনারকেও প্রত্যাহার করা উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ধরিত্রী রক্ষায় আন্দোলন (ধরা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কীম বলেন, এই সাদা পাথরকাণ্ডে প্রধান যে ব্যক্তিকে দায়ী করা উচিত ছিল তিনি হলেন বিভাগীয় কমিশনার। তার এমন পরিবেশবিরোধী বক্তব্যই পরিবেশ ধ্বংসে উসকে দিয়েছে লুটপাটকারীদের। কিন্তু তাকে স্বপদে রাখা হলো। এমনকি পাথর লুটকাণ্ডে যার সমালোচনা সব স্থানে সেই ইউএনও আজিজুন্নাহারকে কোম্পানীগঞ্জ থেকে ভালো উপজেলা ফেঞ্চুগঞ্জে পাঠানো হলো। সেটা আমরা আশা করিনি।

অন্যদিকে পাথর লুটকাণ্ডে দুদক সিলেট সমন্বিত কার্যালয়ের এনফোর্সমেন্ট টিম যে প্রতিবেদন দিয়েছে সেখানেও বিভাগীয় কমিশনারের বক্তব্যকে পাথর লুটে উসকানি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, ‘সরকারিভাবে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ থাকলেও তিনি উক্ত বক্তব্যের মাধ্যমে পাথর লুটপাটকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে পাথরসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, পরিবহণ শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ স্বার্থরক্ষায় ভূমিকা রেখেছেন।’

এসব বিষয় নিয়ে বুধবার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় কথা বলেন বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী। তিনি বলেন, তিনি যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তা কখনোই লুটপাটে উসকানি দেওয়ার মধ্যে পড়ে না। তিনি বৈধভাবে পাথর উত্তোলনের পক্ষে কথা বলেছেন, তাও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে। তিনি আরও বলেন, যাদের ব্যর্থতায় এই কাণ্ড ঘটেছে তারা যে কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তা হোক শাস্তির আওতায় আসবেই।

দায়িত্ব নিয়েই অভিযানে নতুন ডিসি : এদিকে দায়িত্ব গ্রহণ করেই সাদাপাথরে ছুটে গেলেন সিলেটের নবাগত জেলা প্রশাসক মো. সারোয়ার আলম। বৃহস্পতিবার বিকালে দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি সাদাপাথর পরিদর্শনে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানগুলো ঘুরে দেখেন এবং পাথর প্রতিস্থাপনের কাজ তদারকি করেন। তিনি বলেন, সাদাপাথর থেকে যাতে আর কোনো পাথর চুরি না হয়, সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি কারা এই লুটের সঙ্গে জড়িত, কেন এবং কিভাবে এমন ঘটনা ঘটেছে তা খতিয়ে দেখা হবে। জনগণই প্রশাসনের শক্তি, ইতোমধ্যেই জনগণ এই লুটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অভিযানকালে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, একটি পাথরও যদি সরানো হয়, জীবন ঝালাপালা করে দেব।

জাফলংয়ে ৩ জনকে কারাদণ্ড : সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন বন্ধে অভিযান চালিয়েছে টাস্কফোর্স। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফরহাদ উদ্দিন অভির নেতৃত্বে জাফলংয়ের জাফলং ব্রিজ, চা-বাগান এলাকা, জুমপাড় ও বল্লাঘাট নদীতে এ অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানকালে বালু ও পাথর বোঝাই ৮টি ইঞ্জিনচালিত স্টিলের বড় নৌকা, ২টি ইঞ্জিনচালিত কাঠের নৌকা এবং ১০টি বারকি নৌকা পিয়াইন নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩ জনকে আটক করে ১ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অভিযানে গোয়াইনঘাট থানার এসআই ওবায়দুল্লাহ, সংগ্রাম বিওপির ক্যাম্প কমান্ডার শহিদুল ইসলামসহ বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা অংশ নেন।

‘এনসিপি সাদা পাথর লুটে জড়িত নয়’ : সিলেটে বিএনপি ও জামায়াতের পর এবার এনসিপি দাবি করেছে তারা কোনোভাবেই সাদা পাথর লুটের সঙ্গে জড়িত নয়। বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে এমন দাবি করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সিলেট জেলা ও মহানগর শাখা। সিলেট জেলা প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এনসিপি সিলেট জেলার প্রধান সমন্বয়কারী নাজিম উদ্দীন সাহান এবং সিলেট মহানগর প্রধান সমন্বয়কারী আবু সাদেক মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম চৌধুরীসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা।

#দৈনিক যুগান্তর

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Sylhet Vision

ছাতকের পরিবেশ রক্ষায় কঠোর অভিযান, ড্রেজার মেশিন ও বাল্কহেড জব্দ

সিলেট পাথর কান্ডে এখনও বহাল তবিয়তে বিভাগীয় কমিশনার

প্রকাশের সময় : ০৪:৩১:৪৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২২ অগাস্ট ২০২৫

সিলেটের ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর লুটের ঘটনায় বিভাগীয় কমিশনারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তীব্র সমালোচনা করছেন পরিবেশবাদীরা। তারা বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবীকে পাথর লুটের ‘উসকানিদাতা’ হিসাবে অভিযুক্ত করছেন।

এদিকে বৃহস্পতিবার দায়িত্ব গ্রহণ করেই সাদাপাথর এলাকায় ছুটে যান সিলেটের নবাগত জেলা প্রশাসক মো. সারোয়ার আলম। যাওয়ার পথে তিনি হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে অভিযানে নামেন। বীভৎস, বিবর্ণ সাদা পাথরের দৃশ্য দেখে তিনি বলেন, কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথরকে আগের রূপে ফিরিয়ে আনতে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অন্যদিকে গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন বন্ধে অভিযান চালিয়েছে টাস্কফোর্স। এ সময় অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত থাকায় ৩ জনকে আটক করে ১ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নেতৃত্বাধীন টাস্কফোর্স। ‘লুট ঠেকাতে ব্যর্থ’ কোম্পানীগঞ্জের ইউএনওর ‘প্রাইজ পোস্টিং’ নিয়েও সমালোচনামুখর পরিবেশবাদীরা।

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, সাদা পাথর লুটের ঘটনায় উসকানিদাতা হিসাবে যার নাম সবার আগে আসে তিনি বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী। পাথর উত্তোলনের দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলন থামাতে পাথর উত্তোলনের পক্ষে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে হাততালি পেয়েছিলেন তিনি।

তার সেই বক্তব্যই পাথর লুটকারীদের সাহস জুগিয়েছে এবং স্থানীয় প্রশাসনকে শিথিল করেছে। একই অভিযোগ করা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনেও। সাদা পাথরকাণ্ডে জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। লুটকাণ্ড ঠেকাতে কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও আজিজুন্নাহার পুরোপুরি ব্যর্থ। এমনকি দুদকের প্রতিবেদনে তার যোগসাজশের কথা বলা হলেও তাকে প্রত্যাহার না করে ভালো স্থানে পোস্টিং নিয়েও নানা সমালোচনা চলছে সিলেটজুড়ে। যদিও ঘটনার প্রায় ১০ দিন পর বুধবার কোম্পানীগঞ্জ সাদা পাথর পরিদর্শনে গিয়ে এসব প্রশ্নের জবাবে কমিশনার বলেছেন, তার বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

তার বক্তব্য ছিল ইজারার মাধ্যমে বৈধভাবে পাথর উত্তোলনের বিষয়ে। অন্য কিছু নয়। তিনি অস্বীকার করলেও ৮ জুলাই নিজ কার্যালয়ে দেওয়া বিভাগীয় কমিশনারের সেই জ্বালাময়ী বক্তব্যের রেকর্ড যুগান্তরের কাছে রয়েছে।

পাথর উত্তোলনসহ ছয় দফা দাবিতে আন্দোলনরত পরিবহণ মালিক-শ্রমিক নেতারা ৮ জুলাই সকাল ৬টা থেকে সিলেট জেলাজুড়ে পণ্য ও গণপরিবহণে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করেন। দুপুরে প্রশাসনের দাবি পূরণের আশ্বাসে কর্মবিরতি স্থগিত করে বিকালে বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে আলোচনায় বসেন আন্দোলনকারীরা। সঙ্গে ছিলেন সিলেটের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা।

ওই সভায় সিলেটের বিভাগী কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী বলছেন, সিলেট কোনো বিচ্ছিন্ন এলাকা নয়, দেশের একটা অংশ। সারা দেশে পাথর উত্তোলন করা গেলে সিলেটে যাবে না কেন? এর সঙ্গে মানুষের জীবন ও জীবিকা জড়িত। তিনি বলেন, আমি মনে করি মানুষ পরিবেশ ও প্রকৃতির বাইরে নয়। মানুষ না বাঁচলে সারা প্রকৃতি-পরিবেশ বাঁচলে কী লাভ। সব সময়ই বলি, আকাশ আছে, বালি আছে, পাথর আছে, মানুষ নাই-তাহলে আপনি কী করবেন?

স্থানীয়দের মতে, জুলাই মাসের শুরুর দিকে এমন বক্তব্যের পরই প্রশাসনের শিথিলতা চোখে পড়ে। সেই সুযোগেই সম্প্রতি সাদাপাথর ও জাফলংয়ে ভয়াবহ লুট হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি-বেলার সিলেটের সমন্বয়কারী শাহ শাহেদা আক্তার যুগান্তরকে বলেন, একজন বিভাগীয় কমিশনার যখন এমন বক্তব্য দেন, তখন আর কারও মনে ভয় থাকার কথা নয় এবং সেটাই হয়েছে। নির্ভয়ে লুটে নিয়েছে লুটপাটকারীরা।

তিনি মনে করেন, বিভাগীয় কমিশনারের এমন বক্তব্য স্থানীয় প্রশাসনকে ছাড় দিতে সহায়তা করেছে। তিনি আরও বলেন, বিভাগীয় কমিশনার সরকারের প্রতিনিধি। পরিবেশ-প্রকৃতি বাঁচানো যার দায়িত্ব তিনি পরিবেশকে খাটো করে বক্তব্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন তিনি সরকার নয়, পাথর ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি হিসাবে কথা বলেছেন। এমনকি তিনি যেসব কথা বলেছেন তা আদালত অবমাননাকর। আদালতের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে যেখানে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকার যেহেতু বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে জেলা প্রশাসককে প্রত্যাহার করেছে, তেমনি সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে বিভাগীয় কমিশনারকেও প্রত্যাহার করা উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ধরিত্রী রক্ষায় আন্দোলন (ধরা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কীম বলেন, এই সাদা পাথরকাণ্ডে প্রধান যে ব্যক্তিকে দায়ী করা উচিত ছিল তিনি হলেন বিভাগীয় কমিশনার। তার এমন পরিবেশবিরোধী বক্তব্যই পরিবেশ ধ্বংসে উসকে দিয়েছে লুটপাটকারীদের। কিন্তু তাকে স্বপদে রাখা হলো। এমনকি পাথর লুটকাণ্ডে যার সমালোচনা সব স্থানে সেই ইউএনও আজিজুন্নাহারকে কোম্পানীগঞ্জ থেকে ভালো উপজেলা ফেঞ্চুগঞ্জে পাঠানো হলো। সেটা আমরা আশা করিনি।

অন্যদিকে পাথর লুটকাণ্ডে দুদক সিলেট সমন্বিত কার্যালয়ের এনফোর্সমেন্ট টিম যে প্রতিবেদন দিয়েছে সেখানেও বিভাগীয় কমিশনারের বক্তব্যকে পাথর লুটে উসকানি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, ‘সরকারিভাবে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ থাকলেও তিনি উক্ত বক্তব্যের মাধ্যমে পাথর লুটপাটকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে পাথরসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, পরিবহণ শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ স্বার্থরক্ষায় ভূমিকা রেখেছেন।’

এসব বিষয় নিয়ে বুধবার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় কথা বলেন বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী। তিনি বলেন, তিনি যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তা কখনোই লুটপাটে উসকানি দেওয়ার মধ্যে পড়ে না। তিনি বৈধভাবে পাথর উত্তোলনের পক্ষে কথা বলেছেন, তাও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে। তিনি আরও বলেন, যাদের ব্যর্থতায় এই কাণ্ড ঘটেছে তারা যে কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তা হোক শাস্তির আওতায় আসবেই।

দায়িত্ব নিয়েই অভিযানে নতুন ডিসি : এদিকে দায়িত্ব গ্রহণ করেই সাদাপাথরে ছুটে গেলেন সিলেটের নবাগত জেলা প্রশাসক মো. সারোয়ার আলম। বৃহস্পতিবার বিকালে দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি সাদাপাথর পরিদর্শনে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানগুলো ঘুরে দেখেন এবং পাথর প্রতিস্থাপনের কাজ তদারকি করেন। তিনি বলেন, সাদাপাথর থেকে যাতে আর কোনো পাথর চুরি না হয়, সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি কারা এই লুটের সঙ্গে জড়িত, কেন এবং কিভাবে এমন ঘটনা ঘটেছে তা খতিয়ে দেখা হবে। জনগণই প্রশাসনের শক্তি, ইতোমধ্যেই জনগণ এই লুটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অভিযানকালে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, একটি পাথরও যদি সরানো হয়, জীবন ঝালাপালা করে দেব।

জাফলংয়ে ৩ জনকে কারাদণ্ড : সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন বন্ধে অভিযান চালিয়েছে টাস্কফোর্স। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফরহাদ উদ্দিন অভির নেতৃত্বে জাফলংয়ের জাফলং ব্রিজ, চা-বাগান এলাকা, জুমপাড় ও বল্লাঘাট নদীতে এ অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানকালে বালু ও পাথর বোঝাই ৮টি ইঞ্জিনচালিত স্টিলের বড় নৌকা, ২টি ইঞ্জিনচালিত কাঠের নৌকা এবং ১০টি বারকি নৌকা পিয়াইন নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩ জনকে আটক করে ১ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অভিযানে গোয়াইনঘাট থানার এসআই ওবায়দুল্লাহ, সংগ্রাম বিওপির ক্যাম্প কমান্ডার শহিদুল ইসলামসহ বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা অংশ নেন।

‘এনসিপি সাদা পাথর লুটে জড়িত নয়’ : সিলেটে বিএনপি ও জামায়াতের পর এবার এনসিপি দাবি করেছে তারা কোনোভাবেই সাদা পাথর লুটের সঙ্গে জড়িত নয়। বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে এমন দাবি করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সিলেট জেলা ও মহানগর শাখা। সিলেট জেলা প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এনসিপি সিলেট জেলার প্রধান সমন্বয়কারী নাজিম উদ্দীন সাহান এবং সিলেট মহানগর প্রধান সমন্বয়কারী আবু সাদেক মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম চৌধুরীসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা।

#দৈনিক যুগান্তর